আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, জীবিত প্রাণীরা নিজে থেকে আলো নিঃসরণ করে? না, এটি জোনাকি পোকা বা রঙিন নিয়ন বাতির মতো উজ্জ্বল আলো নয়—এটি একধরনের অতিক্ষীণ, চোখে দেখা যায় না এমন এক ধরনের আলো, যা প্রতিটি জীবন্ত কোষ স্বাভাবিকভাবে নিঃসরণ করে। এই বিস্ময়কর ঘটনাটির নাম Ultraweak Photon Emission (UPE) বা Biophoton Emission।সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, এই ক্ষীণ আলো জীবনের অনেক গভীর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে। এই আলো আমাদের জীবনের ‘ভেতরের আলোর’ একটি বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
Ultraweak Photon Emission কী?
Ultraweak Photon Emission হল জীবন্ত কোষের ভেতরকার রসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে নিঃসৃত অতিক্ষীণ শক্তির ফোটন বা আলোক কণার নিঃসরণ। এটি Bioluminescence থেকে আলাদা—জোনাকি পোকা বা সামুদ্রিক প্রাণীরা যেমন আলো তৈরি করে, সেটি একটি বিশেষ এনজাইমের সাহায্যে হয়।কিন্তু UPE হয় সব জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে, সারাক্ষণ এবং স্বাভাবিকভাবে, এবং এটি এতই ক্ষীণ যে সাধারণ চোখে দেখা যায় না। দেখতে হলে প্রয়োজন বিশেষ সেন্সিটিভ ক্যামেরা।
কীভাবে এই আলো তৈরি হয়?
কোষে যখন শক্তি তৈরি হয়, তখন Reactive Oxygen Species (ROS) নামে কিছু ক্রিয়াশীল অক্সিজেনজাত অণু তৈরি হয়। এই ROS যখন কোষের চর্বি, প্রোটিন বা DNA-র মতো উপাদানের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, তখন কিছু excited molecules (উত্তেজিত অণু) তৈরি হয়।এই অণুগুলি যখন আবার স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে আসে, তখন তারা অতিরিক্ত শক্তি আলোক কণার (photon) রূপে নিঃসরণ করে। সেটিই হল Ultraweak Photon Emission।এই আলো UV, নীল, লাল থেকে শুরু করে infrared পর্যন্ত নানা রঙের হতে পারে, নির্ভর করে কোন অণুগুলি সক্রিয় ছিল তার উপর। গবেষণায় দেখা গেছে, জীবিত প্রাণী যেমন ইঁদুর বা গাছ UPE নিঃসরণ করে, কিন্তু মৃত প্রাণী করে না। উদ্ভিদ যদি তাপ, রাসায়নিক বা আঘাতজনিত চাপের মধ্যে থাকে, তখন তাদের UPE বেড়ে যায়।এটি প্রমাণ করে, এই আলো শুধুমাত্র জীবনের উপস্থিতিতে ঘটে এবং স্ট্রেস বা রোগের লক্ষণ হিসেবেও কাজ করতে পারে।
এই ক্ষীণ আলো কীভাবে ধরা হয়?
এই আলো দেখতে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন EMCCD ক্যামেরা—অত্যন্ত সংবেদনশীল, ঠান্ডা করে রাখা ক্যামেরা যা খুব ক্ষীণ আলোও ধরতে পারে।সাথে স্পেকট্রাল ফিল্টার ব্যবহার করে জানা যায়, কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো নির্গত হচ্ছে, যার মাধ্যমে কোষের ভেতরে কী ধরনের রসায়নিক বিক্রিয়া চলছে তা বোঝা যায়।
কোথায় কাজে লাগতে পারে এই প্রযুক্তি?
এই ক্ষীণ আলো মাপার প্রযুক্তি ভবিষ্যতে বিপ্লব ঘটাতে পারে অনেক ক্ষেত্রে: চিকিৎসাবিদ্যায়: কোষে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বা কোনো রোগের শুরুতে শনাক্ত করা, টিস্যু বা অঙ্গ কতটা সুস্থ তা বোঝা—সবই সম্ভব হতে পারে।কৃষিতে: গাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে আগেই সতর্ক হওয়া, সঠিকভাবে পরিচর্যা করে ফলন বাড়ানো যাবে।খাদ্য শিল্পে: ফলমূল বা শাকসবজি কতটা টাটকা, সেটাও বোঝা যাবে এই আলোর সাহায্যে।
Ultraweak Photon Emission আমাদের দেখায় যে, জীবন নিজের মধ্যেই এক আলো ধারণ করে, যা নিরব, কিন্তু গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।যখন প্রাণ থাকে, তখন এই আলো থাকে। আর জীবন শেষ হলে, আলোও নিভে যায়। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি দিয়ে আমরা জীবনের গভীরতর রহস্য আরও ভালোভাবে বুঝতে পারব।
